এবার প্রায় ১১৬ বছর পরে ধর্ষণকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত এবং যৌন সম্পর্কে সম্মতির সর্বনিম্ন বয়স আগের থেকে তিন বছর বাড়িয়ে যৌন অপরাধ সংক্রান্ত আইনে বড়সড় সংস্কার আনল জাপান। পূর্বে জাপানে শুধুমাত্র ‘জোর করে যৌনমিলন’কেই ধর্ষণ বলে গণ্য করা হতো। তবে এখন সংজ্ঞা পাল্টে বলা হয়েছে ‘সম্মতিবিহীন যৌনমিলন’ ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। অন্যদিকে যৌনমিলনের ক্ষেত্রে সম্মতির বয়স ১৩ বছর থেকে বাড়িয়ে ১৬ বছর করা হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার ১৬ জুন জাপানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে এ-সংক্রান্ত নতুন আইন পাস হয়। এর আগে ১৯০৭ সালে জাপানে সর্বপ্রথম যৌন সম্মতির আইন পাস হয়। ১১৬ বছর পর সেই আইনে প্রথম পরিবর্তন আনা হলো। এর মাধ্যমে অন্যান্য দেশের আইনের সঙ্গে জাপানে যৌন অপরাধসংক্রান্ত আইন-কানুনের সামঞ্জস্য আনা হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।
সমালোচকদের মতে, জাপানে কাউকে যৌনমিলনে বাধ্য করা হলে আগের আইনে কোনো সুরক্ষা ছিল না, ফলে অনেক যৌন হামলার ঘটনা নিয়ে অভিযোগ করা যেত না। এ ছাড়া আদালতে এ রকম মামলার রায়ে অনেক অসংগতি থাকত। তবে নতুন আইনে বেশ সুস্পষ্টভাবে এমন আটটি পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে ভুক্তভোগীর পক্ষে ‘যৌনমিলনে অসম্মতি জানানো বা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং তা প্রকাশ করা’ বেশ কঠিন।
এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে আছে মদ বা মাদকের প্রভাবে ভুক্তভোগী নেশাগ্রস্ত, সহিংসতা বা হুমকির মুখে অথবা ‘ভীতসন্ত্রস্ত এবং বিস্মিত।’ অন্য একটি পরিস্থিতির কথাও এতে বলা হয়েছে, যেখানে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করা হচ্ছে এবং ‘অসম্মতি জানালে তার পরিণতি কী হবে’ সেটি নিয়ে ভুক্তভোগী চিন্তিত। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে এতদিন পর্যন্ত জাপানেই যৌনমিলনে সম্মতির বয়স সবচেয়ে কম ছিল।
তবে জাপানে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী কারও সঙ্গে যদি কেউ যৌনমিলন করে, তাকে কেবল তখনই সাজা পেতে হবে যখন তার বয়স ভুক্তভোগীর চেয়ে পাঁচ বছর বা তার বেশি হয়। অন্যদিকে জাপানে ধর্ষণের অভিযোগ আনার সময়সীমাও ১০ বছর থেকে ১৫ বছর করা হয়েছে, তাকে ধর্ষণের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা এ ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় পান।
নতুন আইনে যৌন উদ্দেশ্যে ‘গোপনে ছবি তোলাও’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অসতর্ক মুহূর্তে বা বিনা অনুমতিতে মেয়েদের অসংলগ্ন কাপড়ের নিচ দিয়ে ছবি তোলা কিংবা কোনো যৌন কাজের ছবি তোলা এর মধ্যে পড়বে। জাপানে ২০১৯ সালে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্তরা রেহাই পেয়ে যাওয়ার পর যে আন্দোলন শুরু হয়, তারপর আইনে এসব সংস্কার আনা হলো। ২০১৯ সালে এ নিয়ে দেশজুড়ে ‘ফুল হাতে বিক্ষোভ’ শুরু হয়েছিল।
আইনের সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা ন্যায়বিচার চেয়ে এবং যৌন অপরাধের শিকারদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে এসব বিক্ষোভে অংশ নেন। তবে কয়েকজন আন্দোলনকারী বিবিসিকে বলেছেন, এসব আইনি সংস্কারের ফলে পুরো সমস্যার একটি অংশের মোকাবিলা করা যাবে মাত্র। টোকিওভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস নাউ’-এর কাজুসো ইটো বলেন, যৌন সম্পর্ক এবং এর জন্য সম্মতির বিষয়ে বহু প্রজন্ম ধরে জাপানে যে বিকৃত ধারণার প্রচলন ঘটেছে, সেগুলোরও মোকাবিলা করতে হবে।
জাপানে যৌন অপরাধের শিকার হয়ে যখন কেউ প্রকাশ্যে এ নিয়ে মুখ খোলেন, তখন তাদের প্রায়ই হুমকি বা অনলাইনে নোংরা মন্তব্যের শিকার হতে হয়। আন্দোলনকারীরা বলছেন, আইনের সংস্কারের পরও যৌন অপরাধের শিকার ব্যক্তিরা যেন এ নিয়ে অভিযোগ করতে এগিয়ে আসেন, সে জন্য তাদের উৎসাহিত করতে হবে।
জাপানে এ ধরনের অপরাধের শিকার হওয়ার পরও অনেকে অভিযোগ করতে অনাগ্রহী থাকেন। কারণ, জাপানি সমাজে বিষয়টি লজ্জার এবং কলঙ্কের ঘটনা বলে মনে করা হয়। ২০২১ সালে জাপান সরকারের পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, মাত্র ছয় শতাংশ নারী বা পুরুষ এ রকম ঘটনার শিকার হওয়ার পর অভিযোগ করেছেন। জরিপে অংশ নেয়া অর্ধেক নারী বলেছেন, ‘বিব্রতকর’ বলে তারা এ নিয়ে অভিযোগ করতে চাননি।